প্রচ্ছদ বিষয়
টাকাপয়সার প্রতি এক ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি
কথায় বলে, ‘টাকায় কী না হয়।’ এই কথা কিছুটা হলেও সত্য। কারণ অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য টাকাপয়সার প্রয়োজন। অর্থনীতি বিষয়ক একজন সম্পাদক বলেন, ‘সমাজে টাকাপয়সার গুরুত্ব অপরিসীম। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে যদি টাকাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে এক মাসের মধ্যে আতঙ্ক ও যুদ্ধের এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।’
তবে এটাও ঠিক যে, টাকাপয়সা দিয়ে সব কিছু কেনা যায় না। অর্না গরবর্গ নামে নরওয়ের একজন কবি বলেছিলেন, টাকা দিয়ে “আপনি খাবার কিনতে পারেন কিন্তু খিদে নয়; ওষুধ কিনতে পারেন কিন্তু সুস্বাস্থ্য নয়; আরামদায়ক বিছানা কিনতে পারেন কিন্তু ঘুম নয়; জ্ঞান কিনতে পারেন কিন্তু প্রজ্ঞা নয়; চাকচিক্য কিনতে পারেন কিন্তু সৌন্দর্য নয়; জাঁকজমক কিনতে পারেন কিন্তু আন্তরিকতা নয়; আমোদপ্রমোদ কিনতে পারেন কিন্তু আনন্দ নয়; সঙ্গী কিনতে পারেন কিন্তু বন্ধুবান্ধব নয়; পরিচারক কিনতে পারেন কিন্তু বিশ্বস্ততা নয়।”
একজন ব্যক্তি যখন টাকাপয়সার বিষয়ে এক ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখে অর্থাৎ টাকাপয়সা অর্জন করাকে লক্ষ্য হিসেবে না রেখে বরং কোনো লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এটাকে এক উপায় হিসেবে ব্যবহার করে, তখন তা আরও বেশি সন্তুষ্টি নিয়ে আসে। বাইবেল এই সাবধানবাণী দেয়: “ধনাসক্তি সকল মন্দের একটা মূল; তাহাতে রত হওয়াতে কতক লোক . . . অনেক যাতনারূপ কণ্টকে আপনারা আপনাদিগকে বিদ্ধ করিয়াছে।”—১ তীমথিয় ৬:১০.
লক্ষ করুন, ধন বা টাকাপয়সা নয় বরং সেটার প্রতি আসক্তি হল ক্ষতিকর। সত্য বিষয়টা হল, টাকাপয়সাকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হলে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও ভাঙন ধরতে পারে। কয়েকটা উদাহরণ বিবেচনা করুন।
* “আমি সবসময় ভাবতাম, আমার বন্ধু কিশোর হল একজন শান্ত ও সৎ ব্যক্তি। তার সঙ্গে আমার কখনো কোনো ঝামেলা হয়নি। কিন্তু, একদিন সে আমার পুরোনো গাড়িটা কেনে। সেই গাড়িতে কোনো সমস্যা রয়েছে বলে আমার জানা ছিল না। সে লিখিতভাবে এই ‘শর্তে’ গাড়িটা কিনতে রাজি হয়, যদি পরে কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তা হলে সে কিছু দাবি করতে পারবে না। তিন মাস পর সেই গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। কিশোর ধরে নেয়, আমি তাকে ঠকিয়েছি আর সে রেগে গিয়ে আমাকে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে থাকে। তা শুনে আমি একেবারে অবাক হয়ে যাই! আমি যখন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি, তখন সে ঝগড়া করতে শুরু করে এবং হিংস্র হয়ে ওঠে। টাকাপয়সা নিয়ে সমস্যা দেখা দেওয়ার পর কিশোরের মধ্যে যে-অমায়িক মনোভাব ছিল, তা উধাও হয়ে যায়।”
রবি:রুবি: “রূপা হল আমার একমাত্র বোন। আমাদের সম্পর্ক সবসময় ভালোই ছিল, তাই আমি কখনো ভাবিনি, টাকাপয়সার কারণে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হবে। কিন্তু ঠিক সেটাই ঘটে। বাবা-মা মারা যাওয়ার সময় আমাদের জন্য কিছু বিষয়সম্পত্তি রেখে যান আর তাদের ইচ্ছা ছিল, আমরা দু-জনে যেন সমান অংশ পাই। আমার বোন সেটা মেনে না নিয়ে আরও বেশি অংশ দাবি করতে থাকে। আমি যেহেতু বাবা-মায়ের ইচ্ছা মেনে নিয়েছিলাম, তাই সে রাগে ফেটে পড়ে এবং আমাকে হুমকি দিতে থাকে। আজ পর্যন্ত সেই সম্পর্ক তিক্ত হয়ে রয়েছে।”
টাকাপয়সা এবং ভেদাভেদ
টাকাপয়সার প্রতি এক বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি লোকেদের সমালোচনা করতে পরিচালিত করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, একজন ধনী ব্যক্তি এইরকম মনে করতে পারেন, দরিদ্ররা খুবই অলস প্রকৃতির হয়ে থাকে আর তাই তারা জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করার জন্য কোনো কাজ করতে চায় না। অন্য দিকে, একজন দরিদ্র ব্যক্তি হয়তো সহজেই এইরকম মনে করতে পারেন, যাদের বেশি রয়েছে, তারা হল বস্তুবাদী অথবা লোভী। বেশ ধনী পরিবারের এক কিশোর বয়সি মেয়ে লিলি, এইরকম ভেদাভেদের শিকার হয়েছিলেন। তিনি বলেন:
টাকাপয়সার বিষয়ে বাইবেলের পরামর্শ, যখন সেগুলো দেওয়া হয়েছিল, তখনকার মতো এখনও সমান প্রযোজ্য
“সবাই জানত, আমার বাবার প্রচুর টাকাপয়সা রয়েছে। প্রায়ই অন্যেরা এইরকম মন্তব্য করত: ‘তোমার যা-কিছু দরকার, বাবাকে চাইলেই তো পেয়ে যাবে’ কিংবা ‘আমরা তো আর তোমার মতো বড়োলোক নই যে, তোমাদের মতো দামি দামি গাড়ি কিনব।’ আর সহ্য করতে না পেরে আমি আমার বন্ধুদের এইরকম কথা বলতে বারণ করি আর তাদেরকে জানাই, কেন তাদের কথাগুলো আমার খারাপ লাগে। আমি এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হতে চাই না, যার প্রচুর টাকাপয়সা রয়েছে বরং এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হতে চাই, যে অন্যের জন্য সদয় কাজ করে।
বাইবেল যা বলে
বাইবেল বলে না যে, টাকাপয়সা থাকা খারাপ। বাইবেল সেই ব্যক্তিদেরও নিন্দা করে না, যাদের টাকাপয়সা রয়েছে, এমনকী প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। বিষয়টা হল, সেই ব্যক্তির কাছে কত টাকাপয়সা রয়েছে, তা নয় বরং তার কাছে যা রয়েছে অথবা তিনি যা অর্জন করতে চান, সেটার প্রতি তার মনোভাব। টাকাপয়সার বিষয়ে বাইবেল ভারসাম্যপূর্ণ পরামর্শ দেয় আর যখন সেগুলো দেওয়া হয়েছিল, তখনকার মতো সেই পরামর্শ এখনও সমান প্রযোজ্য। নীচের উদাহরণটা লক্ষ করুন।
বাইবেল বলে: “ধন সঞ্চয় করিতে অত্যন্ত যত্ন করিও না।”—হিতোপদেশ ২৩:৪.
দ্যা নারসিসিশম্ এপিডেমিক নামক বই অনুসারে, যারা টাকাপয়সার পিছনে ছোটে, তারা প্রায়ই “মানসিক কষ্ট ভোগ করে; এ ছাড়া, তারা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা, যেমন গলাব্যথা, পিঠে ব্যথা ও মাথা ব্যথায় ভোগে এবং তাদের বেশি মদ খাওয়ার ও অবৈধ ড্রাগ নেওয়ার প্রবণতা থাকে। অর্থনৈতিক সাফল্য পেতে গিয়ে পরিশেষে লোকেরা হতাশ হয়ে পড়ে।”
বাইবেল বলে: “তোমাদের আচার ব্যবহার ধনাসক্তিবিহীন হউক; তোমাদের যাহা আছে, তাহাতে সন্তুষ্ট থাক।”—সন্তুষ্ট থাকার অর্থ এই নয় যে, টাকাপয়সা নিয়ে একজন ব্যক্তির কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না; কিন্তু তিনি দুশ্চিন্তাকে সঠিক স্থানে রাখতে জানেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন সন্তুষ্ট ব্যক্তি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়লে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখান না। এর পরিবর্তে, তিনি প্রেরিত পৌলের মতো মনোভাব দেখানোর চেষ্টা করেন, যিনি লিখেছিলেন: “আমি অবনত হইতে জানি, উপচয় ভোগ করিতেও জানি; প্রত্যেক বিষয়ে ও সর্ব্ববিষয়ে আমি তৃপ্ত কি ক্ষুধিত হইতে, এবং উপচয় কি অনাটন ভোগ করিতে দীক্ষিত হইয়াছি।”—ফিলিপীয় ৪:১২.
বাইবেল বলে: “যে আপন ধনে নির্ভর করে, সে পতিত হয়।”—হিতোপদেশ ১১:২৮.
গবেষকরা বলেন, টাকাপয়সা হল বিভিন্ন বৈবাহিক সমস্যার মূল কারণ, যেগুলো শেষপর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদের দিকে নিয়ে যায়। আত্মহত্যার পিছনেও একটা মূল কারণ হল, টাকাপয়সা সংক্রান্ত সমস্যা। কোনো কোনো ব্যক্তির কাছে টাকাপয়সা তাদের বিয়ের অঙ্গীকার কিংবা জীবনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ! এর বিপরীতে, যাদের ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, তারা টাকাপয়সার উপর নির্ভর করে না। বরং, তারা যিশুর এই কথাগুলোর মধ্যে যে-প্রজ্ঞা রয়েছে, তা বোঝে: “উপচিয়া পড়িলেও মনুষ্যের সম্পত্তিতে তাহার জীবন হয় না।”—লূক ১২:১৫.
টাকাপয়সার প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?
নিজেকে পরীক্ষা করা হয়তো আপনাকে এই বিষয়ে সাবধান হতে সাহায্য করতে পারে যে, টাকাপয়সার বিষয়ে আপনার এক ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে কি না। উদাহরণ স্বরূপ, নিজেকে জিজ্ঞেস করুন:
-
আমি কি তাড়াতাড়ি বড়োলোক হওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যাবসায়িক প্ল্যানের প্রতি আকৃষ্ট হই?
-
আমি কি টাকাপয়সা দান করতে সংকোচবোধ করি?
-
আমার কি এমন লোকেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার প্রবণতা রয়েছে, যারা সবসময় টাকাপয়সা এবং তাদের জিনিসপত্র নিয়ে কথা বলে?
-
আমি কি টাকাপয়সা অর্জন করার জন্য মিথ্যা কথা বলি এবং অন্য কোনো অসৎ উপায় অবলম্বন করি?
-
টাকাপয়সা আছে বলে আমি কি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে মনে করি?
-
আমি কি সবসময় টাকাপয়সা নিয়েই চিন্তা করি?
-
টাকাপয়সার প্রতি আমার মনোভাবের কারণে কি আমার স্বাস্থ্য এবং পারিবারিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?
অন্যদের দান করার মাধ্যমে উদার মনোভাব গড়ে তুলুন
এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে কোনোটার উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তা হলে বস্তুবাদী চিন্তাভাবনা ও প্রলোভন দূর করার জন্য প্রচেষ্টা করুন। এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা এড়িয়ে চলুন, যারা টাকাপয়সা ও বিষয়সম্পত্তিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এর পরিবর্তে, এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা করুন, যারা বিষয়সম্পত্তির চেয়ে উচ্চ নৈতিক মানকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
টাকাপয়সার প্রতি প্রেমকে কখনো আপনার হৃদয়ে শিকড় বিস্তার করতে দেবেন না। এর পরিবর্তে, টাকাপয়সাকে উপযুক্ত স্থানে অর্থাৎ সবসময় বন্ধুবান্ধব, পরিবার, আপনার আবেগগত ও শারীরিক স্বাস্থ্যের পরে রাখুন। তা করার মাধ্যমে আপনি দেখাবেন যে, টাকাপয়সার প্রতি আপনার ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। ▪ (g15-E 09)
^ অনু. 7 এই প্রবন্ধে নামগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে।